১৯৪৭ সালে বাংলাকে ভাগ করে মুসলমানপ্রধান পূর্ববঙ্গকে জুড়ে দেওয়া হোল পাকিস্তান রাষ্ট্রের সঙ্গে।আর পশ্চিমবঙ্গ রইলো ভারতের সাথে।বাংলা ভাগের ফলে ভারত থেকে প্রায় বিশ লক্ষ মুসলমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) আসেন এবং পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ)থেকে প্রায় আটান্ন লক্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ভারতে দেশান্তরী হন।বেসরকারী হিসেবে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশী।
ইতিহাসে বাংলা আগেও বিভক্ত ছিল –রাঢ়,বরেন্দ্র, সমতট,হরিকেল।তবে ১৯৪৭ সালের বিভাজনের মতো তা কখনোই এতটা নিয়ামক ও সুদূরপ্রসারী ছিল না।তখন বাংলা দুই অংশের মাঝে কখনো টানা হয়নি কাঁটাতারের বেড়া।
১৯৪৭ সালে বাংলা ভাগ হয়ে লাভ হল কার?ক্ষতি হল কার?বাংলাদেশ ও ভারতের মাঝে আজ যে সীমান্তরেখা তা হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মাঝের যে বিভাজন রেখা তা স্পষ্ট। এই রেখা বর্তমানে বহু বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালি হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের মনোজগতে যে বিভেদের সৃষ্টি করেছে যা তাদেরকে আজও স্বাধীন বাংলাদেশে মিলতে দেয়না, সমানতালে দুই সম্প্রদায়ের বর্তমান সরকারের উন্নয়নও করতে দেয় না। সরজমিনে উন্নয়নের সাম্প্রদায়িক বিভেদের বহিঃপ্রকাশ সুস্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়।
কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মাইজখার ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কামারখোলা মৌজার হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাসরত পাড়াগুলোর রাস্তা-ঘাট, পুল-কালভার্ট,সরকারি সেবা ও পরিসেবা ও পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ সুবিধা বঞ্চিত হওয়া যেন হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মাঝের ভারত বাংলাদেশের কাঁটাতারের বিভাজন মনোজগতে স্থান নেওয়ার নামান্তর।
বাংলাভাগের ৭৩ তম বার্ষিকীতে ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৯ তম বার্ষিকীতে মনোজগতে স্থান নেওয়া সেই অদৃশ্য সীমান্তরেখাটিকে গ্রামীণ স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাসরত এলাকাটিকে অবহেলিত করে রাখার মূলকারণ তা বুঝতে আজকের এই লেখা।
কামারখোলা গ্রামের কুমার পাড়ার আর্টিস রতন দাদা কে প্রশ্ন করলাম আপনি ভারত যাচ্ছেন না কেন? তিনি বলেন “বাংলাদেশে জন্মেছি বলে নাড়ীর একটা টান আছে তাইতো সকল বাঁধা প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশকেই আমার আপন মনে হয় তাই।”
১৯৪৭ সালের দেশ ভাগ আমাকে অনেক তাড়িত করে। ভারতবর্ষকে ভাগ করা কি খুবই দরকার ছিল। এই ভাগ ইতিহাসের এক বিকৃতি। দেশ ভাগের সময় রাজনীতিবিদরা আচরণ করেছেন তাদের নিজ নিজ সংকীর্ণ দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থ অনুযায়ী।তখনকার সময়ের নীতিনির্ধারকরা নেপথ্যে কাজ করে গেছে তাদের মতো করে যা আজও ঠিক যেন চান্দিনা মাইজখারের কামারখোলা দায়িত্বরত থাকা জনপ্রতিনিধিরা উন্নয়ন করে যাচ্ছেন তাদের মতো করে হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের বিভেদের কথা মাথায় রেখে। তবে তা সাধারন ভাবে বলা যাবে না যে সব নেতারা দেশ ভাগের পক্ষে ছিলেন। শরৎ বোস,আবুল হাসেম,সৌরয়ার্দীদের শেষের দিকে যেমন করে দেশভাগের বিপক্ষে অবস্থান করে ছিলেন এমনি করে চান্দিনার হিন্দু সম্প্রদায়ের উন্নয়ন করে যাচ্ছেন কিছু স্থানীয় রাজনীতিবিদরা যা সফলতা পায়নি বলে মনে করা হচ্ছে।
কামারখোলা মৌজার হিন্দু সম্প্রদায়ের অবহেলিত কুমার পাড়ার প্রবাসী সুজন পালের সাথে কথা বলি কুমার পাড়ার বর্তমান জীবন ধারা, অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক,সামাজিক ও সরকারের দেওয়া সুযোগ সুবিধার বঞ্চিত বিষয়ক নানা দিক নিয়ে।
তিনি জানান “আমাদের কুমার বাড়ির ঐতিহ্য বলতে মৃৎ শিল্প টাই আসল। আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষ স্বর্গীয় শ্রী যুক্তবাবু কৃষ্ণ চন্দ্র পালের বংশ ধর। তাঁর ছিল প্রচুর ধন সম্পদ। একথায় কামারখোলা গ্রামের ফসলি মাঠের পূর্ব অংশের জমি সহ অনেক স্থাবর অস্থাবর সম্পদ ছিল। যা এখনো পুরানো গ্রামের জমির দলিলে তাদের নাম উল্লেখ্য আছে। আর আমাদের পাড়ায় একজন পাকিস্তান আমলের মেম্বার ও ছিলেন। উনার নাম ছিল স্বর্গীয় শ্রী যুক্তবাবু রমেশ চন্দ্র পাল।উনার পরিবার সহ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতে চলে গেছেন।
আর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরই কয়েক পরিবার ভারতে যাওয়ার সূচনা শুরু হয়।আর এই ভারতে যাওয়ার সূচনাকে কেন্দ্র করেই আমাদের পাড়ার সম্পদশালী ব্যক্তিরা সম্পদ বিক্রি করে নিজেদের ইচ্ছায় ভারতে চলে গেছেন।আমাদের কে আমাদের গ্রামের মুসলমান ভাইয়েরা আদিকাল থেকে অনেক সম্মান করে আসতেছেন। যদি ও কালের পরবর্তনে আজ কুমার পাড়ায় হত দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছ।এক সময় আমাদের কুমার পাড়ায় তিন তিনটা দূর্গা পূজা হত।আজ অনেক বছর ধরে আমাদের পাড়ায় একটি দূর্গা পূজা ও করা হয় না। তার পিছনের কারণ হল আর্থিক ও সামাজিক একাত্মতার অভাব ও রাজনৈতিক সমন্বয়হীনতার অভাব তো বটেই। আমাদের কুমার পাড়ার সমাজটা এখন ২/৩ টা গ্রুপে ভাগ করা আছে। আমি আমার সিনিয়র অনেকের সাথে আলাপ করেছি যে সবাইকে এক করে আমরা একটা সমাজ গঠন করতে পারি কি না।এই ব্যাপারে আমি দেশে এসে সবার সহযোগিতায় কামারখোলা গ্রামের কুমার পাড়ার আর্থিক উন্নয়নে কাজ করাই হবে আমার প্রথম কাজ।
এবার বলা যাক আমাদের যোগাযোগব্যবস্থার কথা।
আমাদের পাড়ায় রাস্তা ঘাটের অবস্থাটা খুবই খারাপ হওয়ার কারণেও আমরা অনেক টা পিছিয়ে আছি।আর এই যোগাযোগ ব্যবস্থাটা যেন একটু উন্নত করা যায় তাই আমরা কয়েকজন মিলে আজ থেকে ১২/১৩ বছর আগে আমাদের কুমার পাড়া কার্জন খালের পূর্ব পাশে (রামমোহন বাজার টু চান্দিনা) রাস্তার সাথে জমির দক্ষিণে অংশে খাসের জায়গার উপর দিয়ে একটি রাস্তা বের করি এবং কার্জন খালের উপর একটি বাশেঁর (সাক্কু) পুল তৈরি করি যা এখনো ব্রীজে রূপান্তরিত করা হয় নাই।আর এই বাশেঁর পুল এবং রাস্তা বের করতে গিয়ে আমি নিজে গোপাল নগরের মুসলমান সম্প্রদায়ের ছেলে ছদ্মনাম (মারুনের) হাতের মাইরও খেয়েছি। আমি আমার গোষ্ঠীর সবার মতামত নিয়ে আমাদের পুকুরের উত্তর পাড় রাস্তার জন্য ছেড়ে দিতে একমত হই। আর এই বাশেঁর পুল এবং রাস্তার জন্য কয়েক বার আমরা চান্দিনা উপজেলায় দরখাস্ত দিয়েছিলাম। এর এক পর্যায়ে আমি জীবিকার তাগিতে দুবাই চলে আসলাম। দুঃখের বিষয় হল দেশ এত ডিজিটাল হচ্ছে অথছ আমরা তার কোন ছোঁয়া পাচ্ছি না।এখন আমি এলাকার সবার সহযোগিতা কামনা করছি যেন সবাই মিলে এই বাশেঁর পুল এবং রাস্তার টা নির্মাণে ভূমিকা রাখেন।আমাদের কামারখোলা গ্রামের সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে যারা সরকারি চাকরী করছেন তাদের নিকট সাহায্য কামনা করছি যেন উক্ত পুল- কালভার্টসহ রাস্তাটা তৈরি করার জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
এই পুল এবং রাস্তা হলে আমাদের এলাকার৫/৬ গ্রামের লোকজনের আসা- যাওয়া এবং কুমার পাড়ার মৃৎ-শিল্প সহ মাঠের কৃষকের জন্য অনেক উপকারে আসবে।এগুলো গ্রামের আদর্শবান লোকজনের সহযোগিতা ছাড়া করা সম্ভব নয় বলে আমি মনে করি।”
কুমার পাড়ার বেসরকারি চাকুরীজীবি লিটন পাল কে কার্জন খালের উপর দিয়ে পুল-কালর্ভাটসহ রাস্তা না করে আপনাদের অবহেলিত করে রাখার জন্য মাঝে মাঝে কি ভারতে দেশান্তরী হতে মন চায় কি না জাতে চাই। তিনি বলেন” না, কখনো না, কেননা দেশভাগ হলেও আমার জন্মভূমি কি বদলেছে আমার জন্মভূমি বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া স্বাধীন সোনার বাংলাদেশ। তাই শত প্রতিকূল অবস্থার মাঝেও আমাদের পূর্ব পুরুষরা দেশ ত্যাগ করেনি আমাদের প্রজন্মের তো প্রশ্নই উঠেনা।”
রতন আর্টিস দাদার ছেলে জীবন পাল কলেজ পড়ুয়া ছাত্র মনে করেন “যারা কার্জন খালের উপর দিয়ে পুলসহ রাস্তা তৈরিতে বাঁধা দিচ্ছে এ পরিনতি ও মন-মানসিকতার জন্য আমি দেশভাগকেই দায়ী করবো।যদি ১৯৪৭ সালে দেশভাগ না হতো তাহলে আপনিও বলার সুযোগ পেতেন না যে দাদা ভারতে দেশান্তরী হওয়ার কোন ইচ্ছা আছে কিনা।”
কুমার পাড়ার গ্রাম্য ডাক্তার সুমন দা মনে করেন “দেশ ভাগ যেমন রাজনৈতিক কারণ ছিল কামারখোলা গ্রামের কুমার পাড়ার আজকের যে অবহেলিত পাড়া করে রাখা হয়েছে তাও বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থার রাজনৈতিক কারণ বলে আমি মনে করি।চান্দিনার জনপ্রতিনিধিরা বলে থাকেন চান্দিনার উন্নয়ন হয়েছে আকাশ চুম্বী ও হে সে উন্নয়ন হয়েছে আমিও স্বীকারকরি। যাকে বলা যায় লম্বালম্বি আকাশচুম্বী উন্নয়ন কেননা তা যদি না হতো চান্দিনা উপজেলা মাইজখারের কামারখোলা মৌজার হিন্দু সম্প্রদায়ের পাড়া সরকারের এই ডিজিটাল উন্নয়নের ধারায় এতো অবহেলিত হয়ে থাকা হতো না।”
কামারখোলা গ্রামের পূর্বপাড়ার মালদ্বীপ প্রবাসী খলিল জানান “কুমার পাড়া সত্যি একটা অবহেলিক হিন্দু সম্প্রদায়ের পাড়া। যদি ঐ পাড়ার পূর্ব পাশের কার্জন খালের উপর দিয়ে পুল কালর্ভাটসহ রাস্তা করে দেওয়া যায় তাহলে তাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ব্যাপক পরিবর্তন অাসবে যার ফল হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের সকলে ভোগ করবে।মনুষ্যত্ব বলে যে ভাবনা চিন্তার অস্থিত্ববিদ্যমান তার জন্য হিন্দু মুসলমান সম্প্রতি বেড়ে কুমার পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে কামারখোলাসহ আশেপাশের মুসলমানদের কাছাকাছি নিয়ে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।”
কার্জন খাল একটি ঐতিহাসিক বাস্তবতার সাক্ষী। এই খাল খনন করা হয়েছিল যাতায়াত ও কৃষিআবাদ বৃদ্ধি করার জন্য। হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের বিভেদ তৈরি করার জন্য নয়।তবে কি কার্জন খালটাই কি কামারখোলা গ্রামের কুমার পাড়াকে অবহেলিত করে রাখার ক্ষেত্রে চির অমর হয়ে রইবে,কুমার পাড়ার হিন্দু সম্প্রদায়ের দাদারই জানে মাটির তৈরি হাড়িপাতিল ও যাতায়াত করার জন্য এই আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায়ও প্রায় প্রতিদিন দুই থেকে তিন কিলোমিটারের রাস্তা পায়ে হাটতে হয়। আর যদি কুমার পাড়া সংলগ্ন কার্জন খালের উপর পুল ও রাস্তা নির্মান হয় তাহলে দূরত্ব কমে হয়ে যাবে মাত্র চারশ পাঁচশ মিটার। কুমার পাড়াকে অবহেলিত করে রাখার জন্য রাজনীতি ও জনপ্রতিনিধিদের রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা থাকলেও থাকতে পারে।তবে মানবতার প্রশ্নে চান্দিনায় বঙ্গবন্ধুর সমাজ দর্শনের প্রশ্নে এ এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের জন্ম নয়তো।কার্জন খালের উপর পুল না থাকার কারণেই তাদের আজকের এই অবহেলার দূরদশা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশে।এটি একটি বিপর্জয় হয়েই রইবে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায়।
তবে এটা আমিও বিশ্বাস করি চট করে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।ইউরোপের অনেক দেশে হিন্দু মুসলমান বা জাতিগত বা রাষ্ট্রীয় আলাদা ব্যবস্থা থাকলেও তাদের মনের মধ্যে আামাদের মনের মতো সাম্প্রদায়িক কনসার্ন মাথায় রেখে উন্নয়ন দর্শন চর্চা করে না বলে জানি।
আমি পরিশেষ চান্দিনাসহ বাংলার দুঃখী মানুষের নেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার ও তাঁর চান্দিনা রাজনীতিক প্রশ্নে আস্থা ও ভরসার পঞ্চাশ বছরের মূর্তপ্রতীক মাননীয় সংসদ সদস্য আলী আশরাফ এমপির সুদৃষ্টি কামনা করছি।
মোঃ খোরশেদ আলম
এমফিল, রিসার্চ ফেলো এন্ড পিও টু পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ড.ওয়াজেদ রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
পিতা: মরহুম আলহাজ্ব এম এ লতিফ, কর্মন্দের বাড়ি কামারখোলা পশ্চিম পাড়া,মাইজখার, চান্দিনা।