।।চান্দিনা প্রতিনিধি।।
প্রতিটি সন্তানের কাছে প্রিয় ব্যক্তিত্ব তাঁর বাবা,ঠিক আমার বাবাও তেমনই প্রিয় ব্যক্তিত্ব আমার কাছে। অন্যদের তুলনায় ভিন্নতা এতটুকু বলবো আমার বাবা যখন অন্যদের কাছেও প্রিয় ব্যক্তিত্ব বলে জানতে পারি তখন আমার বুকটা গর্বে ভরে উঠে। একজন সৎ, আদর্শবান ও সর্ববিষয়ে পারদর্শী মানুষেরাই হতে পারেন একাধিক জনের কাছে প্রিয় ব্যক্তি বলে আমি মনেকরি।
আমার বাবা কামারখোলা পশ্চিম পাড়া জামে মসজিদের সভাপতির দায়িত্বে থাকা আলহাজ্ব এম এ লতিফ। আজ বাবা নেই। তিনি গত ২৭ অাগস্টের ২০১৯ ইং সন্ধ্যায় ইন্তেকাল করেন। বাবার স্মৃতি ভেসে আসছে তার কর্ম ও দক্ষতায়। একদিকে বাবা হারানোর বেদনা অপরদিকে বাবার বিভিন্নকর্ম স্মৃতিতে বুকটা গর্বে ভরে উঠছে।
একবার কামারখোলা পশ্চিম পাড়া জামে মসজিদের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে প্রায় অক্ষম ছিলেন আমার বাবা। এদিকে মাহীন সংসারে বৃদ্ধ বাবার সংসারটাও চলতে ছিলো না। সেলামত জেঠা আছন জেঠার নিকট আমার বাবা মসজিদের বিল বিষয়ক আলাপ করতে ছিলেন তবু কোন সমাধান বেড় হয়ে আসতে ছিলো না।বাবার মনে ভয় নাই? আমি আমার বাবার পাশে বসা তখন। বাবার দিকে তাকিয়ে আছি। দেখি তিনি মুচকি হাসলেন আর জবাব দিলেন আব্দুল লতিফকে ফতুর করে দিলেও লতিফ এর মনে বিন্দুমাত্র ভয় তোমরা তৈরী করতে পারবে না।আব্দুল লতিফ এর গরিবী হালত যদি কারো সামনে প্রকাশ পাবে তাইলে সেটা শুধুই আল্লাহর কাছে পাবে সবার আগে। আর কারো সামনে কখনোই এই অসহায়ত প্রকাশ করবো না।সেই আত্মবিশ্বাস মানুষটিই আমার বাবা। আমার ঐ বিদ্যুৎ বিল গুলো পরিশোধ করছেন আমাদের পড়াশোনার খরচ সংকোচিত করে।তার সংস্পর্শে আসা মানুষদের আমি দেখেছি বাবাকে পাগলের মত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসতেন।
আমার বাবা আলহাজ্ব এম এ লতিফ চান্দিনার কামারখোলা গ্রামের কর্মন্দের বাড়ির সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪০ সালের ১৫ জুন জন্ম গ্রহণ করেন।পেশাগত জীবনে তিনি কৃষির আধুনিকায়নে কাজ করে গেছেন।তাঁর জীবদশায় প্রাচীন ৯০০ শতক জমির কৃষি চাষাবাদের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। বাবার মৃত্যুর খবর শুনে দেশে ও দেশের বাইরে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে থাকা তার কামারখোলাবাসী ফোন দিয়ে যখন তাদের অনুভূতির কথাগুলো আমাকে বলছেন তখন বাবাকে নিয়ে আমার গর্ববোধ হয়। তাদের সবাই ক্রন্দনরত অবস্থায় আমাকে বললেন পিতাকে শুধু তুমি হারালে না, আমরাও হারালাম আমাদের গ্রামের একজন স্বপ্নদ্রষ্টাকে।
বাবার লাশ নিয়ে যখন গ্রামের বাড়ি চান্দিনা থেকে কামারখোলা গ্রামের প্রবেশ করি তখন বাজে রাত প্রায় ২ টা। সেই সময়ও শত শত মানুষ আসে তাকে বিদায় জানাতে তার জানাজাতে। লোকজনে একাকার হয়ে যায় আমাদের গ্রাম। চেয়্যারম্যান থেকে শুরু করে ঢাকা ও চট্রগ্রাম থেকেও মানুষ ছুটে যায় তাকে শেষ বিদায় জানাতে। সেই সময় আমি দেখেছি তার সমবয়সী বন্ধু যারা ছিলো তারা বাদেও যারা তাকে সমাজসেবক হিসেবে ঐ ভাবে দেখেনি শুধু বাপ দাদাদের কাছ থেকে তার কথা শুনেছে তারা কি পরিমাণ কেঁদেছেন।
আমার বাবা ছিলেন সাহসী স্বপ্নবাজ মানুষ । একজন গ্রামীণ সমাজসেবক। একজন অভিভাবক। একজন অনুপ্রেরণার মানুষ। একজন সফল মানুষ। যিনি শত বাঁধা উপেক্ষা করে, মানুষের বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করে লজিং থেকে শত শত মানুষের ভালোবাসা ও অনুপ্রেরণার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। তাকে দেখে প্রতিনিয়তই শিখতাম।
আল্লাহর প্রতি ছিলো অগাধ বিশ্বাস। মৃত্যু শেষ কয়দিন তিনি অল্প খেতে পারতেন। মৃত্যুর আগে তাকে আমি জোর করে একটি পাকা আম খাইয়েছিলাম। এটিই ছিলো তার শেষ খাওয়া আমার হাত দিয়ে । তাকে খাওয়া নিয়ে জোর করলে তিনি জবাব দিতেন আল্লাহ আমার রিজিক কমিয়েছেন আবার তিনিই বৃদ্ধি করবেন।আব্বুকে যখন বলতাম আব্বু না খেলে ওষুধ খাবে কিভাবে? আর ওষুধ না খেলে সুস্থ হবে কিভাবে? তিনি উত্তর দিতেন আল্লাহর অনুমতি ছাড়া আমি এক সেকেন্ড আগেও যাবো না।আমাকে নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, একথা বলেই তিনি মুচকি হাসি দিতেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি যখন যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন তখনও তিনি আমাকে বলছিলেন খোরশেদ বাবা, আমি নামাজ পড়বো।
গত ২৩ অক্টোবর বিকেলে দোয়া মাহফিল ও আলহাজ্ব এম এ লতিফ ট্রাস্ট এর উদ্ভোধন সভায় উপস্থিত বাবার সম বয়সী ও মুরুব্বীদের আলোচনায় বাবার কর্মজীবনের অনেক কথাও জেনেছি। তারা বলেছেন কামারখোলা গ্রামের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি ইট, ঘাস,লতাপাতা জানে আমার বাবা কতটা শ্রম দিয়ে গ্রামের সামাজিক প্রতিষ্ঠান গুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা, পরিশ্রম, সময় ও মেধা খরচ করেছিলেন। তার অশ্রু, ঘাম বৃথা যায়নি। কামারখোলাবাসীর হৃদয়ে তিনি ঠিকই স্থান করে নিয়েছিলেন এবং থাকবেন চিরকাল।
কৃষিময় কর্মজীবনের শেষ সময়ে তার কিছু ক্ষোভ ছিলো। কারন গ্রামে কৃষি কাজকে প্রতিষ্ঠা করার পর একসময় যারা কাজের জন্যে দিনের পর দিন আমাদের বাসায় এসে বসে থাকতো, যাদের পরিবারের আমার বাবার সবচেয়ে বেশি অবদান তারাই পিছনে পিছনে তার নামে মিথ্যা অপবাদ দিতো। কারন তারা জানতো তাকে বিতর্কৃত করতে পারলে আমাদের বাপ চাচার বন্ধন টা ভেঙ্গে ফেলা যাবে, যারফলে তাদের অনৈতিক কাজের বিরোধিতা করার কেউ থাকবে না, আমাদেরকে সামাজিক ভাবে ছোট করে রাখতে পারবে। সেই বেঈমানীর কারনে তিনি দুঃখ পান। সেই রাগ আর ক্ষোভ থেকে তিনি ২০১৩ সাল খেকে গ্রামে বসবাস না করে চট্রগ্রামে আমার বড় ভাই এমরান বিন ইউসুফের বাসায় বসবাস করেন মৃত্যুবরণের দিন পর্যন্ত।
যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলতো তারা নিজেরাও জানতো যে, তারা যা করছে তা ভুল। কিন্তু শুধুমাত্র আমাদের একান্নবর্তী পরিবারকে ভেঙ্গে দিয়ে সামাজিক ভাবে উপরে উঠার জন্য এই জঘন্য কাজ তারা করেছিলো। সেই বেঈমানদের কাছেও যদি এই মহান গ্রামীণ সেবক সম্পর্কে এক লাইনে জানতে চাওয়া হয় তাহলে তারাও বলতে পারবে না তিনি ভালো মানুষ ছিলেন না।
ভাবতে অবাকই লাগে যে, মানুষ কিভাবে ভুলে যায় তার অতীতের কথা। যিনি না থাকলে তাদের সামাজিক কোন অস্থিতই ছিলো না, যিনি ছিলেন তাদের মাথার উপরে ছায়ার মতো, সেই তার মত ব্যক্তিকে নিয়ে কথা বলতে কি বেঈমানদের হৃদয় একটুও কাপলো না? অনেক দুঃখ নিয়ে কথাগুলো লিখলাম। সত্য অমানুষদের কাছে সবসময় অপ্রিয় হয়। তাদের কাছেও কথাগুলো ভালো লাগবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আর সহ্য করতে না পেরে, বাবার শেষ জীবনে অমানুষদের কাছ থেকে অমানুষিক কষ্ট পাওয়ার কথাগুলো তাই বলতে বাধ্য হলাম।
বাবা তুমি দোয়া রেখো তোমার রেখে যাওয়া এমরান,মহসীন ও খোরশেদ যেন তোমার স্বপ্নগুলো পূরন করতে পারে আলহাজ্ব এম এ লতিফ ট্রাস্টের মধ্য দিয়ে।
কামারখোলাবাসীর নিকট রেখে যাওয়া আলহাজ্ব এম এ লতিফ সাহেবের ছোট ছেলে মোঃ খোরশেদ আলম ।